শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৮ পূর্বাহ্ন
ভিশন বাংলা ডেস্কঃ আজ বিশ্ব এইডস দিবস। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সচেতনতা প্রচারণার অংশ হিসেবে প্রতিবছর পহেলা ডিসেম্বর সারাবিশ্বেই এইডস দিবস পালন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার অব ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) কর্তৃক ১৯৮১ সালে প্রথম হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি) সনাক্ত হয়। এরপর ১৯৮৮ সালে গঠন করা হয় আন্তর্জাতিক এইডস সোসাইটি। ওই বছর পহেলা ডিসেম্বরকে বিশ্ব এইডস দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। চলতি বছর এই দিবসের ৩০তম বার্ষিকী পালিত হতে হচ্ছে। এবার দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘নো ইউর স্ট্যাটাস’। অর্থাৎ এইডস বিষয়ে প্রত্যেকে নিজের অবস্থান জানুন।
এইচআইভি’র সংক্রমণে মানবদেহে এইডস রোগের সৃষ্টি হয়। তবে এইডস আলাদাভাবে কোনো রোগের নাম নয়, বরং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাবজনিত নানা রোগের সমাহার। এইডস এক আতঙ্কের নাম। এইচআইভি ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে দেহের রোগ প্রতিরোধক কোষ যেমন হেলপার টি সেল, মনোসাইট, ম্যাক্রফেজ, ডেনড্রাইটিক সেল, চর্মের ল্যাঙ্গারহেন্স সেল, মস্তিষ্কে ও গায়াল সেল ইত্যাদিকে আক্রমণ করে এবং সেগুলোকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়। ফলে মানবদেহের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। তখন যেকোনো জীবাণু সহজেই এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিকে আক্রমণ করতে পারে। এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার এই অবস্থাটাই এইডস।
বেশীরভাগ এইডস রোগীই কোনো লক্ষণ ছাড়াই এই রোগ বহন করে থাকেন। তবে কখনো কখনো এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ পরে কিছু অনির্দিষ্ট লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এইডস হলে সাধারণত জ্বর, র্যাশ ওঠা, গলা ব্যথা, লসিকাগ্রন্থী ফুলে যাওয়া, শরীর ব্যথা, গিরায় গিরা ব্যথা, ডায়রিয়া, মাথা ব্যথা, মুখে ঘা হওয়া, জননাঙ্গে ঘা, মস্তিষ্কে এবং মস্তিষ্কের পর্দায় প্রদাহ ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়।
বাতাস, পানি, খাদ্য অথবা সাধারণ ছোঁয়ায় বা স্পর্শে এইচআইভি ছড়ায় না। মানবদেহের কয়েকটি নির্দিষ্ট তরল পদার্থে (রক্ত, বীর্য, বুকের দুধ) ইত্যাদির মাধ্যমে এইচআইভি ছড়াতে পারে। আক্রান্ত রোগীর রক্ত সুস্থ ব্যক্তির দেহে পরিসঞ্চালন করলে, তার ব্যবহৃত সূঁচ বা সিরিঞ্জ অন্য কোনো সুস্থ ব্যক্তি ব্যবহার করলে, তার অঙ্গ অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করলে, আক্রান্ত মায়ের মাধ্যমে (গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালে বা সন্তানের মায়ের দুধ পানকালে, অনৈতিক ও অনিরাপদ দৈহিক মিলন করা ইত্যাদির প্রভাবে সুনির্দিষ্টভাবে এইডস ছড়ায়।
মনে রাখা উচিত, এইচআইভি সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু এইডস হয় না। আবার এইচআইভি ভাইরাস একবার কোনোভাবে শরীরে প্রবেশ করলে তাকে পুরোপুরি দূর করাও যায় না। এই অবস্থায় শরীরে প্রতিরোধ করার মতো কোনো কার্যকারী কোষ না থাকায় যেকোনো রোগ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং শরীরে নানা উপসর্গসহ এর বিস্তার ঘটে। এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ওষুধ এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। তাই প্রতিরোধ করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে এর থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন। এইচআইভি পজিটিভ হলে তাৎক্ষণিক মৃত্যু ঘটে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে একজন রোগী দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারেন। আক্রান্ত ব্যক্তি নিজে যেমন ভোগেন, সঙ্গে পরিবার বা সমাজের অন্যদের জন্যও হুমকি হয়ে থাকেন।
তাই ভয়াবহ এইডস প্রতিরোধে অনিয়ন্ত্রিত যৌনজীবন পরিহার বা অনিরাপদ যৌন আচরণ থেকে বিরত থাকা, পায়ুপথে সঙ্গম পরিহার, ইনজেকশন নেবার সময় জীবাণুমুক্ত সিরিঞ্জ ও সূঁচের ব্যবহার, রক্ত গ্রহণ ও দানের সময় বা অঙ্গ প্রতিস্থাপনের আগে রক্তে এইচআইভি রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করা, আক্রান্ত মায়ের সন্তান গ্রহণ বা সন্তানকে বুকের দুধ দেয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ, অন্য কোনো যৌন রোগ থাকলে দ্রুত চিকিৎসা নেয়া, ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলা, সুন্নতে খতনা/মুসলমানি করানো ইত্যাদি পদক্ষেপ অন্যতম। এ ছাড়াও এইচআইভি ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গীকেও চিহ্নিত করে পরীক্ষা এবং চিকিৎসা করানো উচিত। কেননা এইচআইভি সংক্রমণের বেশিরভাগ ঘটনাই অরক্ষিত যৌনমিলনের কারণে ঘটে থাকে। নারী-পুরুষ যেকোনো মানুষের শরীরে এইচআইভি পাওয়া গেলে তাকে ভয় পাওয়া, ঘৃণা করা বা তার কাছ থেকে দূরে থাকা উচিত নয়। তাকে সমবেদনা জানানো, যত্ন করা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। রোগটি ঘৃণার হলেও মানুষ তো আর ঘৃণার পাত্র নয়।
এইডস শুধু একটি স্বাস্থ্য সমস্যাই নয়, বরং উন্নয়ন সমস্যা যা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিকগুলোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই সরকার এবং অন্যান্য সামাজিক শক্তি ও সংগঠনকে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে এইডস রোগীদের চিকিৎসা সুবিধা, প্রতিরোধ এবং আক্রান্তদের প্রতি সামাজিক নিগ্রহ ও বৈষম্যমূলক আচরণ পরিহার করার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে এইডস সম্পৃক্ত মৃত্যু শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। এইডস প্রতিরোধে সকলকে সচেতন হতে হবে।
লেখক : চেয়ারম্যান, মেডিসিন বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন : আতাউর রহমান কাবুল